Thursday, September 25, 2025

সূর্যগ্রহণ কি সত্যিই বিপদ ডেকে আনে? জেনে নিন যা কেউ আপনাকে বলবে না!

0 comments
 আজ থেকে মাত্র ৪০০০ বছর আগে, চীনের এক সম্রাট তার দুই জ্যোতিষীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন! কারণ? তারা সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেননি। 
আর মাত্র কয়েক দিন আগেই আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল... একই ঘটনার জন্য।
কী এমন আছে সূর্যগ্রহণে যা হাজার বছর ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে? কেন এই কয়েক মিনিটের ঘটনা পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দেয়?

আজ আমরা জানব সূর্যগ্রহণের সেই অবিশ্বাস্য সত্য যা আপনার চোখ খুলে দেবে!


বন্ধুরা! যেমনটা শুনলেন, সূর্য গ্রহণ এমন এক মহাজাগতিক ঘটনা যা প্রাচীনকালে যেমন মানুষের মনে ভয় আর বিস্ময় তৈরি করত, আজও ঠিক তেমনই করে। এই ঘটনাটি শুধু আজকের নয়, এর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরোনো। রাজারা সিংহাসন হারিয়েছেন, যুদ্ধ থেমে গেছে, আবার জন্ম নিয়েছে কতশত গল্প আর কুসংস্কার।

আজকে আমরা জানবো:

১. কেন এবং কীভাবে এই গ্রহণ হয়? (এর পেছনের সহজ বিজ্ঞান)

২. ইতিহাস জুড়ে মানুষ একে কীভাবে দেখেছে? (কিছু গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প)

৩. এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গ্রহণ চলাকালীন কী করা উচিত এবং কোনগুলো নিছকই কুসংস্কার?

 

চলুন, এই মহাজাগতিক যাত্রায় একসঙ্গে সামিল হই!"

 

"প্রথমেই আসি, এই গ্রহণ কেন হয়? বিষয়টা আসলে একটা মহাজাগতিক লুকোচুরি খেলার মতো। আমাদের পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, তেমনই চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চারদিকে।

 

যখন এই তিনটি বস্তুসূর্য, চাঁদ এবং পৃথিবীঘুরতে ঘুরতে একই সরলরেখায় চলে আসে এবং চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করে, তখন চাঁদের ছায়া পৃথিবীর ওপর পড়ে। পৃথিবীর যে অংশ জুড়ে ওই ছায়া পড়ে, সেখান থেকে সূর্যকে আর দেখা যায় না বা আংশিকভাবে ঢাকা পড়ে যায়। আর একেই আমরা বলি সূর্য গ্রহণ।

 

মজার ব্যাপার হলো, সূর্য চাঁদের চেয়ে ৪০০ গুণ বড়, আবার চাঁদ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সূর্যের দূরত্বের ৪০০ ভাগের এক ভাগ। এই অদ্ভুত গাণিতিক কারণেই পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্যকে প্রায় একই আকারে দেখায়। তাই চাঁদ সহজেই সূর্যকে ঢেকে ফেলতে পারে।

 

এই গ্রহণ তিন ধরনের হতে পারেপূর্ণগ্রাস (Total), যেখানে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে; খণ্ডগ্রাস (Partial), যেখানে সূর্যের একাংশ ঢাকা থাকে; এবং বলয়গ্রাস (Annular), যেখানে চাঁদ সূর্যকে ঢাকলেও চারপাশে একটি আগুনের বলয় বা রিং অফ ফায়ার দেখা যায়।"

 

বিজ্ঞান তো সহজ, কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর আগে মানুষ যখন দেখত তাদের আলোর উৎস, তাদের দেবতা সূর্যকে কিছু একটা গিলে ফেলছে, তখন তাদের মনের অবস্থা কী হতো, ভেবে দেখুন তো?

 

হিন্দু পুরাণ: আমাদের এই উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনীটি হলো রাহু ও কেতুর। সমুদ্র মন্থনের সময় অসুর রাহু ছলনা করে অমৃত পান করলে, মোহিনীরূপী বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে তার ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা করে দেন। কিন্তু অমৃত পানের কারণে তার মুণ্ড ও ধড় অমর হয়ে যায়। সেই ছিন্ন মস্তকটিই হলো 'রাহু' এবং ধড়টি হলো 'কেতু'। রাহুর সেই কাটা মাথা সূর্য ও চন্দ্রের ওপর প্রতিশোধ নিতেই সময়ে সময়ে তাদের গ্রাস করে ফেলে। আর তখনই হয় গ্রহণ।

 

চীন: প্রাচীন চীনে মনে করা হতো, এক স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই গ্রহণ শুরু হলেই চীনারা ড্রাম, বাসন-কোসন বাজিয়ে বিকট শব্দ করত, যাতে সেই ড্রাগন ভয় পেয়ে সূর্যকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজ থেকে চার হাজার বছর আগে চীনের শিয়া রাজবংশের সম্রাট চং খাং তখন ক্ষমতায়। সেই সময়ে সম্রাটকে মনে করা হতো 'স্বর্গের পুত্র'। অর্থাৎ, আকাশ বা স্বর্গের সাথে পৃথিবীর মানুষের সংযোগ স্থাপনকারী। তাই আকাশে যা কিছু ঘটত, তার সরাসরি প্রভাব সম্রাটের সম্মান এবং শাসনের ওপর পড়ত।

 

তার রাজসভায় দুজন রাজকীয় জ্যোতির্বিদ ছিলেনতাদের নাম ছিল হি এবং হো (Hsi and Ho)। তাদের কাজ শুধু তারা দেখা বা দিনপঞ্জি বানানো ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মহাজাগতিক ঘটনা, বিশেষ করে সূর্যগ্রহণের নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করা। কারণ, আগেই বলেছি, চীনারা মনে করত এক স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গিলে ফেলে। তাই গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই যদি জানা যায়, তবে ড্রাম বাজিয়ে, তীর ছুড়ে সূর্যকে বাঁচানোর প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।

 

কিন্তু সেই বিশেষ দিনে যা ঘটল, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।

 

হঠাৎ, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, দিনের বেলা আকাশ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করলো। সূর্যকে যেন এক অদৃশ্য দৈত্য গ্রাস করছে। রাজদরবারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। প্রজাদের মধ্যে শুরু হলো হাহাকার। সূর্যকে বাঁচানোর জন্য যে ড্রাম বাজানো হবে, তীর ছোড়া হবেসেই প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই পাওয়া গেল না।

 

আর এর জন্য দায়ী কে? রাজদরবারের প্রধান দুই জ্যোতির্বিদ, হি এবং হো!

 

অভিযোগ ওঠে, তারা নিজেদের কর্তব্যে এতটাই অবহেলা করেছিলেন যে তারা মদ্যপানে মত্ত ছিলেন এবং এই বিশাল মহাজাগতিক ঘটনা তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।

 

সম্রাট চং খাং-এর জন্য এটা ছিল চরম অবমাননা এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এই অপ্রত্যাশিত গ্রহণকে স্বর্গের তরফ থেকে তার শাসনের প্রতি একটি অনাস্থা হিসেবে দেখা হতে পারত, যা রাজ্যে বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারত। হি এবং হো-র এই ব্যর্থতা শুধু একটি বৈজ্ঞানিক ভুল ছিল না, এটি ছিল সম্রাটের ক্ষমতার প্রতি এক বিরাট হুমকি।

 

ফলাফল? মৃত্যুদণ্ড।

 

সম্রাট তার দুই সর্বোচ্চ জ্যোতির্বিদকে শিরশ্ছেদের আদেশ দিলেন। কারণ তারা শুধু একটি গ্রহণ দেখতেই ব্যর্থ হননি, তারা সম্রাটের সম্মান এবং স্বর্গীয় অধিকারকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন।

 

ভাইকিং: উত্তরের ভাইকিং যোদ্ধারা বিশ্বাস করত, স্কল (Sköll) এবং হাটি (Hati) নামের দুটি বিশাল নেকড়ে সারাক্ষণ আকাশে সূর্য ও চন্দ্রকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যখন তারা ধরতে পারে, তখনই গ্রহণ হয়।

 

শুধু গল্পই নয়, ইতিহাসে এর বাস্তব প্রভাবও ছিল। গ্রহণের ভয়ে যুদ্ধ থেমে গেছে, রাজারা নিজেদের ভাগ্য গণনা করতে জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হয়েছেন। এই মহাজাগতিক ঘটনাটি ছিল একাধারে ভয় এবং শ্রদ্ধার।

 

"এবার আসি সবচেয়ে জরুরি অংশে। গ্রহণ নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন। কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা শুধুই ধারণা?

 

প্রথমেই বিজ্ঞান কী বলে:

Is Solar Eclipse a Danger

গ্রহণ দেখার সময় সবচেয়ে বড় সতর্কতা হলোকখনোই, কখনোই খালি চোখে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকাবেন না। এটা কোনো কুসংস্কার নয়, এটা খাঁটি বিজ্ঞান।

 

কেন? গ্রহণের সময় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির (UV rays) তীব্রতা অনেক বেশি থাকে, যা আপনার চোখের রেটিনাকে চিরতরে পুড়িয়ে দিতে পারে। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা, আপনি এটা টেরও পাবেন না, কারণ রেটিনায় কোনো ব্যথা অনুভব করার কোষ নেই।

 

কীভাবে দেখবেন? গ্রহণ দেখার জন্য বিশেষ সোলার ফিল্টারযুক্ত চশমা বা ওয়েল্ডার গ্লাস (শেড ১৪ বা তার বেশি) ব্যবহার করুন। অথবা ঘরেই বানিয়ে নিতে পারেন পিনহোল প্রজেক্টর। এর মাধ্যমে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে নিরাপদে গ্রহণ উপভোগ করতে পারবেন।

 

এবার আসি প্রচলিত কিছু ধারণায়:

আমাদের সমাজে কিছু বিশ্বাস প্রচলিত আছে, যেমন:

১. গর্ভবতী নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ: বলা হয়, এতে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটি সম্পূর্ণ একটি কুসংস্কার।

২. গ্রহণ চলাকালীন খাওয়া বা রান্না করা নিষেধ: অনেকেই ভাবেন, এই সময়ে খাবার বিষাক্ত হয়ে যায়। এটাও একটি ভুল ধারণা। খাবার বা জলের ওপর গ্রহণের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না।

৩. গ্রহণের পর স্নান করা: অনেকে শুদ্ধ হওয়ার জন্য এটা করে থাকেন। এটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অংশ হতে পারে, তবে এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক বাধ্যবাধকতা নেই।

 

মূল কথা হলো, সূর্য গ্রহণ একটি প্রাকৃতিক এবং সুন্দর ঘটনা। ভয় না পেয়ে, সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করে এটি উপভোগ করুন।"

 

"তাহলে আমরা দেখলাম, সূর্য গ্রহণ কোনো অভিশাপ বা অশুভ সংকেত নয়, বরং চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর সরলরেখায় অবস্থানের এক অসাধারণ মহাজাগতিক মুহূর্ত। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই বিশাল মহাবিশ্বে আমরা কতটা ক্ষুদ্র, অথচ কত সুন্দর এক মঞ্চের অংশ।

 

আজকের এই বিশেষ দিনটি আপনি কীভাবে কাটাচ্ছেন? আপনার এলাকায় গ্রহণ নিয়ে কী ধরনের লোককথা বা বিশ্বাস প্রচলিত আছে? আমাদের কমেন্ট করে অবশ্যই জানান।

 

লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে এবং নতুন কিছু জানতে পারেন, তাহলে অবশ্যই একটি লাইক দিন। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরও এই মহাজাগতিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করুন। চাঁদগ্রহণের রহস্য নিয়ে জানতে আমাদের আগের এই লেখটি পড়ুন। 

0 comments:

Post a Comment